কাদেরের সঙ্গে অফিসের প্রথম দিনই আমার ভাব হয়ে গেল । বেচারা যেন কাউকে খুঁজছিল একটু প্রানখুলে শ্বাস নেয়ার জন্য । আমার আসাতে সেটা হয়তো সম্ভব হল ।
তবে কাদেরের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ভাব হওয়াটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধই বলা যেতে পারে । আপনি যখন ওকে প্রথম দেখবেন, আপনার পিলে চমকাবে । তারপর যখন ওকে প্রানান্তকর চেষ্টায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখবেন, আপনার ভয় ক্রমশ করুণায় পরিবর্তিত হবে, এবং অবধারিতভাবে একসময় সেটা পরিনত হবে উপহাসে । ওকে কথা বলতে দেখাটা তখন আপনার দৈনন্দিন বিনোদনের একটি অংশ হয়ে যাবে ।
যদি একটুও না বাড়িয়ে বলি, তাহলে বলতে হয় কাদেরের মুখটা চরম বিদঘুটে । মুখের ডানপাশের চামড়া কালো হয়ে ভয়ংকরভাবে কুঁকড়ে আছে কান পর্যন্ত । এতে পুরো মুখটা অদ্ভুতভাবে বেকে গেছে । ওর মুখের ফুটোটা তাতে মাঝামাঝি না থেকে সরে গেছে বেশ অনেকটা ডানদিকে । ওকে কথা বলতে হয় এই নতুন অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে । প্রতিটা শব্দ উচ্চারনের সময় ওকে ঘাড়টাকে ডানদিকে কাত করে নিতে হয়, যেন অনেকটা শক্তি খরচ করে ঠেলে কথাগুলো বের করছে । কথা প্রসঙ্গে কাদেরের কাছ থেকেই শোনা, ছোটবেলায় কোন এক দূর্ঘটনায় ওর মুখের ডানপাশটা পুড়ে যায়, সে কারনেই ওটার এই অবস্থা ।
অফিসের সবাই ওকে আড়ালে আবডালে এবং কখনও বা প্রকাশ্যেই কুৎসিত কাদের বলে ডাকে । ও যখন অফিসের কোন মিটিংয়ের মাঝখানে কোন কিছু বলতে যায়, তখন বাকি সবাই মুখ চাপা দেয় হাসি ঢাকবার জন্য । কেউ কেউ চেপে না রাখতে পেরে স্বশব্দে হেসে ওঠে । তখন কাদেরও হাসে । অদ্ভুত ভংগিতে, অদ্ভুত শব্দে হাসে । হেসে যেন অন্যদের হাসির অমানবিকতাটুকু ঢাকতে চায় ।
এই কুৎসিত কাদেরের সাথে প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হবার মুল কারণ হচ্ছে ওর গায়ে পড়া সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব । সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, কিংবা আমার কাজ সম্পর্কে ধারনা দেয়া, এসব ও যেচে এসেই করতে লাগলো । আমার একটা অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে আমি কখনই চট করে অপরিচিত মানুষজনের সংগে মিশতে পারি না, যদি না অপরপক্ষ এগিয়ে আসে । সেক্ষেত্রে কাদেরের সাথে ভাব হওয়াটা কাদেরের কারণেই সম্ভব হল ।
ক্রমেই কাদের আর আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগলো । একটা সময় এমন হল, আমি হয়ে গেলাম কাদেরের ট্রান্সলেটর । ও মুখ ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে যে কথাগুলো বলে, আমি সেগুলোকে সবার বোধগম্যভাবে অনুবাদ করে দিই । কেন যেন ওর কথাগুলো আমি সহজেই বুঝতে পারি ।
আর যখন আমরা একসংগে থাকি, প্রচুর কথা বলে কাদের । কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যায়, তবু থামে না । ওর ছোটবেলা থেকে এই বড়বেলার সব কথা সে অনর্গল বলে যায় । আমি বুঝতে পারি, এই কথাগুলোর বেশীরভাগেরই প্রথম এবং একমাত্র শ্রোতা আমি । আমিই হয়তো তার জীবনে আসা একমাত্র ব্যক্তি, যে সময় নিয়ে তার কথাগুলো শুনছে । এ জন্য সে তার অতীতের সব গল্প উজাড় করে বলতে লাগলো । কাদেরের জীবনের বেশীরভাগ ঘটনাই বঞ্চনার, কিংবা উপহাসের । যেটুকু অর্জনের, সেগুলোতে তার যে সে কি ভীষনরকম পরিশ্রম জড়িয়ে, শুনে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে যাই । করুণা, উপহাস ছাপিয়ে কাদেরের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের পরিমান দিন দিন বাড়তে থাকে ।
এভাবে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল । সব কিছুই ঠিক ছিল, সমস্যা বাঁধল অফিসের নতুন নিয়োগের পর । আমি আর কাদেরের মাঝের ডেস্কে এতদিন কবির সাহেব বসতেন । ভদ্রলোক বেশ খামখেয়ালি মানুষ, হঠাৎ ই চাকরি ছেড়ে দিলেন । তার জায়গায় নতুন আসলেন বৃষ্টি- বৃষ্টি ম্যাডাম । উনি আমার দুই বছরের জুনিয়র, সেই হিসেবে কাদেরের চার বছরের । বৃষ্টি ম্যাডামের আগমনের দিনই আমি কাদেরের হাবেভাবে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । কেমন যেন একটা জড়তা তার মধ্য ভর করল । আমি ভয়াবহ একটা কিছুর আশংকা করলাম ।
বৃষ্টি ম্যাডাম এককথায় অনন্য অসাধারন সুন্দরী । ভীষন খরতাপের পর এক পশলা বৃষ্টি হলে যেমন লাগে, বৃষ্টি ম্যাডামকে দেখার পর আপনার ঠিক সেই রকম অনুভূতিই হবে । যতবার দেখবেন ততবারই হবে । আমারও হল, সন্দেহ নেই, কাদেরেরও হল । তবে ওর অনুভূতির তীব্রতা বোধহয় একটু বেশিই ।
কাদেরের আচার আচরনের পরিবর্তন ক্রমেই বাড়তে লাগলো । বৃষ্টি ম্যাডামের সামনে তার কাপাকাপি আর কেউ খেয়াল না করলেও আমিই ঠিকই বুঝতে পারছিলাম । কুৎসিত কাদের নিঃসন্দেহে বৃষ্টি ম্যাডামের প্রেমে পড়েছে ।
একমাসের মাথায় কাদের আমাকে কথাটা বলল । আমি পড়লাম মহা বিপদে । কি করে বোঝাই কাদেরকে ! বললাম, “কাদের ভাই, বৃষ্টি ম্যাডাম কত সুন্দরী না ! উনি কি আর এতদিন খালি আছেন, আমি শিওর, উনি এঙ্গেজড ।” কাদের সজোড়ে মাথা ঝাকায় । বলে, “কক্ষনো না । ও এঙ্গেজড হতেই পারে না । হলে তো অফিসে সারাদিন ফোনে কথা বলত, ওর কথা শুনে আমরা বুঝতে পারতাম । কই, বলে তো না !” আমি দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ি । উনি ফের শুরু করেন, “আমার কেন যেন মনে হয়, ওর ও আমার প্রতি আলাদা কিছু ফিলংস আছে । দেখো না, আমি যখন কথা বলি, ও তখন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ।” ব্যাপারটা আমিও লক্ষ্য করেছি, তবে তার ঐ দৃষ্টিতে আমি করুণা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাই নি । হায়রে ভালোবাসা ! ভালোবাসা সত্যিই মানুষকে অন্ধ করে দেয় । যে লোক সারা জীবন মানুষের করুণার দৃষ্টি সহ্য করল, সে আজ সেই দৃষ্টটাকেই বুঝতে পারছে না !
কাদের তার পকেট থেকে একটা চিঠি বের করল । আমাকে দায়িত্ব দিল এই চিঠিখানা বৃষ্টি ম্যাডামকে যেন পৌছে দিই । ও যা বলতে চায়, সেটা ও মুখে বললে হয়তো সেটার আবেদন পুরোটাই হারিয়ে যাবে, তাই চিঠিই ভরসা । রাজ্যের অনিচ্ছা সত্বেও আমি চিঠিটা নিলাম । এ ছাড়া আর কিইবা করার আছে ।
চিঠিটা পড়তে গিয়ে ভীষনরকম ধাক্কা খেলাম । এত অদ্ভুত সুন্দরভাবে ভালোবাসার কথা লেখা চিঠিটিতে, পড়তে পড়তে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল । যদি না জানতাম চিঠিটির লেখক কে, আমি অতি অবশ্যই তার প্রেমে পড়তাম । চিঠিটা যেন আমাকে সম্মোহন করে ফেলল । আমি কাদেরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলাম ।
পরদিন অফিসে কাদের বারবার ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে চিঠির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলল । আমি প্রতুত্তরে বোঝালাম সময় হলেই ব্যবস্থা নেব । অবশেষে অফিস ছুটির একটু আগে বৃষ্টি ম্যাডামকে গিয়ে বললাম, “একটু সময় হবে ম্যাডাম, জরুরী কথা ছিল ।” উনি সায় জানালেন । বললেন, “অফিস শেষে একসাথে বেরুবো । জরুরী কথা কোথাও বসে শোনা যাবে ।”
আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম । আমি ক্রমাগত ঘামছি, ভীষন নার্ভাস ফিল করছি । কুৎসিত কাদের তাকে প্রেম পত্র দিয়েছে এই কথা শোনার পর বৃষ্টির প্রতিক্রিয়ার কথা অনুমান করে রীতিমত শংকিত আমি । যা থাকে কপালে, আমি বুক পকেটে হাত দিয়ে চিঠি বের করলাম ।
আমার হাতে চিঠি দেখেই বৃষ্টি রিনিঝিনি শব্দে হেসে উঠল । যথারীতি আমার মনে হল এক পশলা বৃষ্টি এইমাত্র আমায় ভিজিয়ে দিয়ে গেল । আমি মুগ্ধ নয়নে বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । ও হাসতে হাসতেই বলল, “চিঠি এনেছেন, চিঠি ! এখনকার যুগে চিঠি !” হাসি আর থামেই না । বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে কোনমতে বলল, “এনেছেন যখন আপনিই পড়ে শোনান, আমি শুনি ।” আমি বৃষ্টির মুখের উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না, তাই চোখ বন্ধ করে ফেললাম । চোখ বন্ধ অবস্থাতেই চিঠিটা খুলে মুখের সামনে মেলে ধরলাম । তারপর চোখ খুলে পড়তে শুরু করলাম ।
চিঠি পড়ে শেষ করতে হয়তো মিনিট পাচেক লাগলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে পড়ছি । আমি ভয়ে ভয়ে চিঠি থেকে চোখ সরিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকালাম । আশ্চর্য, বৃষ্টি কাদছে ! ওর চোখ ভর্তি জল । বৃষ্টির ক্রন্দনরত এই মুখ দেখে আমি আবার মুগ্ধ হলাম ।
রাত আটটার দিকে কাদেরকে ফোন করলাম । ওর কন্ঠ উত্তেজনায় কাঁপছে । আমি ওকে তখনই আমার বাসার সামনের রাস্তায় আসতে বললাম । ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ও আমার বাসার সামনেই আছে এখন । আমি দ্রুত নিচে নেমে এলাম ।
কি বলব মোটামোটি গুছিয়েই রেখেছি । কাদের দম বন্ধ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি কিছু লম্বা দম ফেলে শুরু করলাম । “কাদের ভাই, আমার স্কুল জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে বলি । স্কুল জীবনে আমি চরম খারাপ ছাত্র ছিলাম । প্রতিদিন, প্রতিক্লাসে স্যাররা আমাকে পড়া ধরতেন, আমি পারতাম না । স্যাররা ভয়াবহ অপমান করতেন, পুরো ক্লাসে দাড় করিয়ে রাখতেন । আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম । হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, স্যাররা যখন আমাকে বকতেন, তখন ক্লাসের সবাই মুখ চেপে হাসলেও, ক্লাসের ফার্স্টগার্ল মেয়েটা হাসতো না । সে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো । এই ব্যাপারটা সব সময়ই ঘটতে লাগলো । আমিও যা বোঝার বুঝে নিলাম । যেই আমি ইরেজীতে একটা বাক্য লিখতে কষ্ট হত, সেই আমি ঐ মেয়েকে ইম্প্রেস করার জন্য পুরো ইংরেজীতে প্রেমপত্র লিখলাম । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই চিঠি গিয়ে পড়ল সোজা এক স্যারের হাতে । উনি আমাকে দাড় করিয়ে ক্লাসের সবার সামনে ভুল বানানে, ভুল সেন্টেন্সে ভরা চিঠিটা পড়তে লাগলেন । উনি একটা বাক্য পড়েন, পুরো ক্লাস হাসতে থাকে । তবে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, সবচেয়ে জোরে, অট্টহাসি হাসছিল ঐ ফার্স্টগার্ল মেয়েটা ।”
আমি কাদেরের মুখের দিকে তাকালাম । লোকটার কুৎসিত মুখ বেয়ে দুটো জলের ধারা বইছে । কাদের তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুখ মুছল । আমার কাধে একটা হাত রেখে বলল, “এখন আমি যাই, কাল অফিসে দেখা হবে ।” আমি বেশ অবাক হলাম । এই প্রথম কাদেরের কথাগুলো বুঝতে আমার কষ্ট হল, বাকি সবার যেমন হয় ।
আমি জানি কাদের ভয়াবহ দুঃখ পেয়েছে । ওর মন ভেংগে খানখান হয়ে গেছে । কিন্তু ওর মুখটা এত বিদঘুটে, এত কুৎসিত, চোখ মুছে ফেলার পর ওর মুখ দেখে ওর মনের খবর বোঝার সাধ্য কারও নেই । কুৎসিত কাদেরের কুৎসিত মুখ । এই মুখ নিয়ে বৃষ্টির মত মেয়ের প্রেমে পড়ার চিন্তাটাও তো কুৎসিত ।
হঠাৎ আমার মোবাইলটা বেজে উঠল । ধরতেই ও প্রান্তে বৃষ্টির রিনিঝিনি কন্ঠ । “এই যে, কি করছেন ?” “এই তো কিছু না, রাস্তায় হাটাহাটি করছি ।” “কেন ফোন করলাম জানেন, আজকে বলা আপনার চিঠিটার প্রতিটা শব্দগুলো কানে এখনও বাজছে । আমি কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছি না । এত অদ্ভুত সুন্দর করে কি করে লিখলেন আপনি । আপনার অনুভূতিগুলো এত্ত সুন্দর ! আমার কি মনে হয় জানেন ! এই চিঠি যদি আপনি না লিখে ঐ কুৎসিত কাদেরও লিখতো, আমি হয়তো ওনারও প্রেমে পড়ে যেতাম । ” আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল । কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, “দেখো বৃষ্টি, উনার নাম তো কাদের, কুৎসিত কাদের না, কুৎসিত কাদের কেন বলছ ? এইসব আমার মোটেও পছন্দ না ।” বৃষ্টির হাসির আওয়াজ পেলাম । বলল, “আপনি খুব ভালো মনের মানুষ তো, তাই এই সব পছন্দ না । আচ্ছা, আপনি এত ভালো কেন ?” আমি অস্ফুটে বললাম, “জানি না তো !” বলে ফোনটা কেটে দিলাম ।
আমি জানি আমি ভালো মানুষ না । আমি কুৎসিত । এতটাই কুৎসিত, আমি কখনই হয়তো আর আয়নার সামনে দাড়াতে পারবো না, কখনই না ।